উভচরের গল্প অথবা ঘুনে ধরা সমাজের গল্প

Print Friendly, PDF & Email

উভচরের গল্প অথবা ঘুনে ধরা সমাজের গল্প

ছেলেটার নাম উভচর। মা বাবার দেয়া নাম নয়, ঘুনে ধরা সমাজের দেয়া নাম। কতো আর হবে ছেলেটার বয়স! দশ কী এগারো। কিন্তু এই বয়সেই জীবনের অনেক অচেনা দিক দেখা হয়ে গেছে। বিকেল বেলা মাঠে গিয়ে অন্যছেলেদের সাথে খেলা করা তার হয়ে উঠে না। কেউ ওকে দলে নেয় না, বলে, আবার যদি আমাদের সাথে খেলতে আসিস তাহলে মাইর দেবো। জারজ ছেলে, জারজের মতন থাকবি।

জারজ মানে কী? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে উভচর। মাথার ভিতর কোনো উত্তর আসে না। নিরুপায় হয়ে আম্মুকে জিগায়, জারজ মানে কী?
বেঝালী অদ্ভুত চোখে ছেলের দিকে তাকায়, চোখের ভাষা বুঝার বয়স হয়নি উভচরের। তাই বুঝতে পারেনা মায়ের মনের যাতনা। বেঝালী দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, ওসব কুশব্দ বলতে নেই। যাও হাতমুখ ধুয়ে এসো, বরাপিডা খাবে।
বরাপিডা কথায় আর কথা বারায় না উভচর। ওর প্রিয় খাবার বরাপিডা। কোমল মন নিমেষেই সব ভুলে যায়। হাসিমুখে টিপকলের দিকে হাঁটা ধরে। কী হবে জারজের মানে জেনে!
সেই ঘটনার পর থেকে উভচর আর খেলায় মাঠে যায় না, মায়ের মানা। কোমল মন, কতদিন ঘরে বসে থাকা যায়। সে আবার মাঠে যাওয়া শুরু করে। মাঠের ধারে বসে অন্যদের খেলা দেখে। কেউ ওরে খেলতে আহবান করে না। কেউ কথা বলে না, দেখলে না দেখার ভান করে চলে যায়।
উভচর একা থেকে আরও একা হয়ে যায়, যখন ওর প্রিয় বন্ধু, যাকে মনে হতো দুনিয়ার সবচে ভালো মানুষ তারুম এসে বললো, আমি আর তোমার সাথে মিশবো না, কথা বলবো না। মা মানা করে দিয়েছেন। তাই তুমিও আমার সাথে কথা বলবা না আর। আজ থেকে তোমার সাথে আমার আড়ি! শুনে, শ্রাবণের জলধারা নেমেছিল তার চোখে, তার স্থির বিশ্বাস ছিল, আর সবাই চলে গেলেও তারুম তাকে ছেড়ে যাবে না। অভিমানী মন তাই আর অশ্রুর বাঁধ মানেনি। অজোর ধারায় নেমেছিল। কান্নারত ছেলেকে দেখে বেঝালীর মুখে কোনো রা ফুটেনি। ছেলের সাথে নিজেও ঝরিয়েছে বারিধারা। যে বারিধারায় অনেক আগে ভাসিয়েছিল ললাট। চোখের সামনে ভাসতে লাগল মনের সেলুলয়েডে ঘুমিয়ে থাকা ছবিগুলো।

বাপহারা, অনাদর, অভাব আর আবহেলায় ছায়াঘেরা সাপছরি নামক গ্রামে কাটে বেঝালির শৈশব, কৈশোর। কৈশোর শেষ হতে না হতেই বিয়ের আসরে বলতে হয় বেঝালীকে। ছেলে খাগড়াছড়ির খবং পুজ্জির বাসিন্দা। রাজপুত্রের মতন চেহারা। চাকুরীজীবি মা-বাবার অতি আদরের সন্তান। ছেলে আর ছেলের পরিবারের কথা শুনে গ্রামের সকলে ধন্য ধন্য করে উঠলো, বাহ্ বাহ্ দিতে লাগলো আবহমানের সমাজের মাথারা। তাই আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করননি বেঝালী মা। মেয়ের মতামত না নিয়েই বিয়ে দিয়ে ফেললেন। মনে মনে গর্ববোধ করতেন, মেয়ের খুব ভালো বিয়ে দিয়েছেন। কাছের মানুষের কাছে বলতেন, মেয়ে তাহার খুব সুখে আছে। খাগড়াছড়ির বুকে তার শশুরের বিশাল অট্টালিকা।
বেঝালীর মায়ের এই ভুল ভাঙ্গে কয়েকমাস যেতে না যেতেই। এক অঘোর ঝর-বাদলের রাতে মেয়ে এসে হাজির। দুচোখে বন্যা। বেঝালী মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদঁতে কাদঁতে বলতে লাগল, মা আমি আর এই জীবন রাখবো না। বিষ দাও মা, মরে বাঁচি।
হতভম্ব মা কিছু বলতে পারে না। মা মেয়ে কাঁদে, কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে যায়। মা শুনে মেয়ের জামাইয়ের কুকীর্তির কথা।

শান্তিচুক্তির পরপরই খাগড়াছড়ির তথাকথিত যুবসমাজ ডুবে গিয়েছিল ড্রাগের সাগরে। নেশায় মত্ত সে যুবসমাজ ভুলে যায় ন্যায় অন্যায়। ভুলে যায় হিতাহীত বোধ। মা-বাবার টাকার সিন্দুক থেকে শুরু করে মুদিদোকানের ক্যাশ বক্স ও ওদের হাত থেকে বাদ যায় না। প্রথম শ্রেনীর ঠিকাদার থেকে শুরু করে রিক্সাওয়ালারা ওদের অপকর্মের শিকার। সে সময়ের বখে যাওয়া সমাজের প্রতিনিধি এই ঝামেলীর জামাই হির্বেধন। যখন আর কোনো কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছিল না নেশায় আসক্ত হির্বেধনকে, পিতামাতা ঠিক করলেন বিয়ে পরাবেন। কিন্তু কলেজ থেকে ঝরে পরা, হিরোইন সেবনকারীর জন্য মেয়ে খুব অভাব। জানাশোনা কোনো পরিবার মেয়ে দিতে রাজী নয়। কিন্তু কি করে জানি তারা ঝামেলীর খবর পেয়ে গেল। দেখতে সুশ্রী ঝামেলী, ফর্সা গায়ের রঙ। বাপহীন দুখী মেয়ে। আর সর্বপোরি ছেলের খবর ওরা জানে না। হির্বেধনের পিতামাতা, অত্যন্ত চতুরতার সহিত নিজেদের বখে যাওয়া সন্তানকে ঝামেলীর হাতে তুলে দিলেন। এতে ওরা বাঁচলেন আর ঝামেলীকে মারলেন।
বিয়ের দ্বিতীয় রাতেই জানতে পারল ঝামেলী, ওর স্বামী নেশায় আসক্ত। মাস ঘুরতেই গায়ে পরল কিল। নেশার ঘোরে অব্যক্ত অত্যাচার। এভাবে চলতে লাগল দিন। প্রথম দিকে শশুর শাশুড়ী ওর পক্ষপাত করলেও পরে বিপক্ষে অবস্খান নিল। বলল, নিজের স্বামীকে রোধ করতে, বশ মানাতে পারে না, সে কেমন মেয়ে? ধীরে ধীরে বুঝতে পারে ঝামেলী, সে শশুরের বাসায় নয়, নরকের আস্তানায় দিনানিপাত করছে। তারপরও একমাত্র মায়ের কথা চিন্তা করে সকল অত্যাচার সহ্য করে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিন যাপন করছিল। কিন্তু সেও পারলো না, আর সহ্য করা সম্ভব হল না গতকালকের অত্যাচারের পর। বলা নেই কওয়া নেই হির্বেধন হুট করে ক্ষেপে উঠল, টাকা দাও টাকা দাও করে মারতে শুরু করে। হতভম্ব ঝামেলী কিছু বুঝে উঠার আগেই মারের তীব্রতায় মূর্ছা গেল। কতক্ষন পর জানেনা, চেতনা ফিরে আসে তার। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামে ঝামেলী। উদ্দেশ্য গ্রামের বাড়ি।

মা কাঁদে মেয়ের কথা শুনে, মেয়ে কাঁদে তীব্র যাতনায়। মা বলে, আর যাওয়া লাগবে না শশুর বাড়ি।
মেয়ে বলে, আমিও যাবো না আর শশুর বাড়ি।
মা মেয়ে আবার নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মেয়ে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে শোক, যাতনা, বেদনা, কষ্ট। গল্পতা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু নিয়তি দেবী কপালে যা লিখে দিয়েছেন তা কী আর অখন্ডন রাখা যায়? নিয়তি দেবী মুচকি হাসলেন আর একদিন সকালে চেয়ারম্যন সাহেবকে নিয়ে ঝামেলীর শশুর শাশুড়ী দরজার কাঠগড়ায় এসে দাড়ালেন। চোখে এক সাগর আবেদন, রাজ্যের প্রতিশ্রুতি। চেয়ারম্যান বাবুর হাতজোড় আবেদন ফেলতে পারলেন না মা মেয়ে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মা মেয়েকে দ্বিতীয় বারের মতন বিদায় দিলেন। কে জানত, এ বিদায় হবে তাদের শেষ বিদায়।
প্রত্যাবর্তনের কিছু কাল ভালোই কাটল। হির্বেধন মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফেরার পর সবকিছু ভালমতন চলতে লাগল। বউকে নিয়ে নতুন ঘরে উঠল। ছোটখাটো ব্যবসা করতে লাগল হির্বেধন। কিন্তু এই যেন বালির প্রাসাদ। হির্বেধন আবার পুরনো বন্ধুদের সাথে মিশতে শুরু করল, ঝামেলীর শত আপত্তি সত্তেও। এবং যথারীতি নেশাতাও শুরু করল। এবং দেখতে দেখতে আগের মতন হয়ে গেল হির্বেধন। নিজের বাসায় বন্ধুদের নিয়ে বসত। ঝামেলীর সব কথা, প্রতিবাদ জলে গেল, চোখের জল শুকিয়ে গেল। পুতুলের মতন হয়ে গেল ঝামেলীর জীবন। কিন্তু এরপরও শেষ রক্ষা হল না।

ঝামেলীর মা, একদিন সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে শুনলেন, ওর মেয়ে হাসপাতালে। কেন? কেও বলতে পারে না। শুধু জানে, ওঁকে যেতে হবে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে। মেয়েকে দেখতে। কোনোমতে রাত পার করে সকালে ছুটলেন খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আর খাগড়াছড়ি পৌছানো হল না, গাড়ী খাগড়াছড়ির পরিবর্তে কালোপাহাড়ের খাদে পড়ে গেল। আর ঝামেলীর মা, মেয়েকে দেখার বদলে ভগবানের কাছে চলে গেলেন। অভাগী ঝামেলীর বখে যাওয়া স্বামী ছাড়া আর কেউ থাকলো না।

সবকিছু মনে আছে ঝামেলীর, হাসপাতাল থেকে ছাড় পেতে পুরা পনেরদিন চলে যায়। মরার কথা ছিল তার, কিন্তু পথচারার কপাল নিয়ে জন্ম তাহার। এত অল্প বয়সে কী দুক্ষের শেষ হয়? ভাঙ্গা কপাল নিয়ে হাসপাতাল থেকে আবার স্বামীর ঘরে ঠাঁই হল তার।

মা, ক্ষিধে পেয়েছে, ছেলের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে ঝামেলী। ছেলে তার কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ক্ষুধার তারনায় এখন ঘুম ভেঙ্গেছে।
এইত এখনি খেতে দিচ্ছি বাপ আমার, বলে, চোখের জল মুছে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

দিন কেটে যায়, সময় চলে আপন গতিতে আপন ঠিকানায়। উভচর খেয়াল করে, ওর বিদ্যালয়ের সবার বাবারা আসেন, ছেলেদের আদর করেন, এইটা ওইটা কিনে দেন। ওর মনও চায় বাবার আদর পেতে, বায়না ধরতে। অবুঝ মন তাই শুধায়, মা, আব্বু কোথায়? কবে আসবে?
নিষ্পাপ দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে ঝামেলীর গলা আটকে যায়, তারপরও বলে, উঠানের নারিকেল গাছে যেদিন নারিকেল ধরবে, ওইদিন তোমার বাবা চলে আসবে।
উত্তর শুনে উভচর নারিকেল গাছের কাছে চলে যায়। বলে, কী গো গাছ! তাড়াতাড়ি বড় হও।
বেঝালী ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বলতে পারে না, তোমার বাবা খুনের অপরাধে কারাগারে। তোমার জন্মেরও আগে থেকে।

সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত নামে, হির্বেধনের বন্ধুরা আসতে থাকে। হির্বেধন নেই, কিন্তু তার বন্ধুরা এখনও মদের আড্ডা বসায়। যাওয়ার সময় কিছু পয়সা দিয়ে যায়। তাই দিয়ে চলে ঝামেলীর সংসার। পাড়ার লোকেরা কানাঘুষা করে। ঝামেলী পাত্তা দেয় না। যে সমাজ ওকে নষ্ট, বখে যাওয়া স্বামী দিয়েছে, ওর জীবনটা তিলে তিলে ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিয়েছে, সে সামাজকে ও মানে না, সমাজের লোকদের মুখে ও থুথু ছিটায়।

টিচার পড়িয়েছেন, জলে ও স্থলে যারা বাস করে তাদেরকে বলা হয় উভচর। জলে নয়, শুধু ডাঙ্গায় থাকে উভচর, তারপরও কেন সবাই ওই নামে ডাকে সে ভেবে পায় না। ওর একটা ভালো নাম আসে, কিন্তু কেউ সে নামে ডাকে না। একবার একলোক বলেছিল, তোমাদের বাড়ীতে প্রতিদিন যে আঙ্কেলরা আসে, তাদের নামের প্রথম অক্ষরগুলো সাঝিয়ে নিস। কেন তোমাকে ওই নামে ডাকে বুঝতে পারবা। সেদিন ও
সব আঙ্কেলদের নাম জেনে নিয়েছে।
উচাতন
ভগদত্ত
চয়ন
রত্নজ্যোতি
উভচর এসব নামের সাথে নিজের নাম মিলায়, কিন্তু কোনো মিল খুঁজে পায় না। এই নাম নাম খেলার চাইতে ওর ভালো লাগে উঠানের নারিকেল গাছটায় পানি দিতে। ইচ্ছে করে, গাছটাকে একটানে বড় করে ফল ধরাতে। ফল ধরলে বাবা আসবে। তাই নারিকেল গাছটার সাথে ওর যত দোস্তী। একা একা গাছটার সাথে কথা বলে।

সময় বয়ে চলে নিরন্তর গতিতে। সবার জীবনে পরিবর্তন আসে, কিন্তু বেঝালীর জীবনটা একই থেকে যায়। চার বন্ধু নিয়মিত আসে, গভীর গভীর রাত পর্যন্ত মাদক সেবন করে। মাঝে মাঝে নিজেরা নিজেরা জগরা বাধায়।
উচাতন বলে, উভচর আমার সন্তান।
ভগদত্ত বলে, উভচর আমার সন্তান।
চয়ন বলে, উভচর আমার সন্তান।
রত্নজ্যোতি বলে, উভচর আমার সন্তান।
উভচর এসব কিছু শুনে না। ঘুমে বিভোর। স্বপ্ন দেখে, বাবার হাত থেকে চকোলেট নিচ্ছে। ঘুমে ঘুমে ওর ঠোঁটের কোনটা একটু সমপ্রসারিত হয়।
আর লক্ষকোটি তারার পানে তাকিয়ে থাকে ঝামেলী। চোখের জল শুকিয়ে গেছে সেই কবে।

উপসংহার
উভচরের আসল নামটা নাই বললাম। কী হবে জেনে? যে ঘৃন্য, ঘুনে ধরা সমাজ ওকে জন্ম দিয়েছে, নাম উপাধী দিয়েছে, সে সমাজের জলজ্যান্ত প্রতিনিধি হয়ে থাক সে। ওকে দেখবে সবাই আর থুথু ছিটাবে সমাজের মুখে।

Share This Post

Post Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.