চাক্‌দের ইতিহাস ও ইতিকথা, লেখক- মং মং চাক্‌ (গিরিনির্ঝর)

অবস্থান ও নামকরনঃ

বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলার মধ্যে বান্দরবানে বেশী বৌদ্ধ ধর্মালম্বী চাক দেখা যায়। তবে কিছু কিছু খৃষ্টান ধর্মালম্বীও আছে। চাকদের একটি বিশেষ অংশ বার্মায় ( বর্তমানে মায়ানমার ) বসবাস করছে। চাকদের ভাষায় চাক শব্দের অর্থ “দাঁড়ানো” চাকরা নিজেদেরকে “আচাকঃ বলে। চাকরা নিজেদের নামের শেষে চক লিখলেও আরাকানীরা চাকদেরকে সাক (Sak এবং কখনও কখনও মিঙচাক বলে ডাকে।

ইতিহাস

আরাকান,রাজা মাংভিলুর পুত্র রাজা  মাংথির  শাসনামলে সাক রাজার নাম ছিল য়েংচো। তার রাজধানীর নাম ছিল মিছাগিরি। রাজা য়েংচোর সময় আরাকান রাজা মাংথি নাবালক ছিলেন। তাই রাজা শাসনের ভার প্রধানমন্ত্রী কোরেংগ্রীর উপর অর্পিত ছিল। মন্ত্রী কোরেংগ্রী তখনকার দিনে জ্ঞানে বুদ্ধিতে অদ্বিতীয় ছিলেন।

 

তিনি রাজ্যের শাসনকর্তার পরামর্শক্রমে এক অদ্ভুদ উপায়ে মিছাগিরি আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। সাক রাজা য়েংচো ছিলেন সাধাসিধা এবং সরল প্রাণ লোক। তাঁর সরলতার সুযোগ বুঝে আরাকানী মন্ত্রী কোরেংগ্রী রাজা য়েংচোকে যুদ্ধে পরাস্ত করার জন্য এক বুদ্ধি বের করলেন।

 

তিনি চারজন মূখ্য সেনাপতির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনীকে সাজালেন এবং প্রতি সেনাদলে একজন দূতের সঙ্গে আরাকানী রাজবংশের রুপে ও বুদ্ধিতে শ্রেষ্টা এক একজন সুন্দরী যুবতীকে বিভিন্ন পথে রাজা য়েংচোর কাছে পাঠালেন। প্রত্যেক দূতের হাতে একই সারমর্মের এক একটি চিঠি লেখা ছিল

 

আরাকান রাজা সাক রাজার সহিত যুদ্ধ করতে চাননা। বরঞ্চ তিনি তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করতে চান এবং তাঁর সম্মতি পেলে লংক্রাক শহর থেকে রাজা মাংথির ভগ্নী ব্রাহ্‌মীকে পত্নী হিসাবে উপহার দিতে চান” উওরোক্ত চিঠিগুলি নিয়ে চারজন দূত চারটি দলে থেকে বিভিন্ন পথে মিছাগিরির অভিমুখে রওনা হলো। ঐ সময় রাজা য়েংচোর রাজধানী মিছাগিরি জয় করতে হলে একটি বিশেষ পথে প্রবেশ করা ছাড়া অন্য কোন পথ ছিলনা। দূতদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী দূত ছিলেন সাংতাং। তিনি সর্বাঙ্গে ঐ বিশেষ পথে স্বল্প সংখ্যাক সৈন্য নিয়ে মিছাগিরি নগরে ঢুকে পড়েন এবং রাজা য়েংচোকে অভুবাদন পূর্বক তাঁর হাতে রাজা মাংথির লেখা চিটিখানি তুলে দেন।

 

 

ওই চিঠিখানি পড়ে রাজা য়েংচো এতই আনন্দিত হয়ে পড়েন যে, আরাকানী দূত সাংতাংকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ, স্বর্নালঙ্কার এবং হস্তী উপহার দেন। তিনি আরাকান রাজার চিঠির উত্তরে বলেন “ তিনি মাংথির ভাগ্নী রাজকুমারী ব্রাহ্‌মীকে সাদরে পত্নীরুপে পেতে চান। তবে তিনি বিয়ের আগে রাজকুমারী ব্রাহ্‌মীর রুপ দেখতে ইচ্ছুক। তিনি আরও বলেন যে, আগামী ৬৯৫ মঘী সনের তাপোথোয় মাসের ১২ তারিখে ( আনুমানিক ১৩৩৩ খ্রী ফেব্রুয়ারী মাসের ১২ তারিখ) তাঁর রাজদরবারে জাঁকজমকের সাথে বিরাট মেলা বসবে। ঐ মেলায় যোগদানের জন্য তিনি রাজা মাংথি এবং তাঁর ভগ্নী ব্রাহ্‌মীকে সাদর আমন্ত্রন জানালেন। আরাকানী দূত সাংতাং রাজা য়েংচোর কাছ থেকে এই সংবাদ নিয়ে রাজা মাংথির কাছে ফিরে গেলেন। এরপর নির্ধারিত ১২ তারিখের মেলার জন্য রাকা য়েংচো উৎসাহের সাথে বিপুল আয়োজনে লেগে গেলেন। অন্যদিকে ঐদিন মিছাগিরি আক্রমনের জন্য আরাকান মন্ত্রী কোরেংগ্রীকে গোপনে সমস্ত সৈন্যদেরকে মিছাগিরির অভিমুখে পাঠালেন। দেখতে দেখতে নির্ধারিত দিনটি এসে গেল। রাজা য়েংচো সাদর আগ্রহে রাজা মাংথির ভগ্নী রাজকুমারী ব্রাহ্‌মীর মিছাগিরিতে শুভাগমনের অপেক্ষায় রইলেন।

 

নিদিষ্ট দিনে ১০,০০০( দশ হাজার) সৈন্য সহ রে অং নামক জনৈক আরাকানী সেনাপতির সাথে রাজকুমারী ব্রাহ্‌মীকে মিছাগিরিতে পদার্পন করলে রাজা য়েংচো তাঁর রূপ দেখে মুগ্ধ হন এবং সানন্দে তাকে পত্নী হিসেবে বরন করে নেন। ইতিমধ্যে আরাকানের মূল সেনাবাহিনী চারদিক থেকে মিছাগিরি অবরোধ করে ফেলে এবং রাজকুমারী ব্রাহ্‌মীর সাথে আগত সৈন্যরা হঠাৎ করে আক্রমন করে বসে। এতে রাজা য়েংচো অনন্যোপায় হয়ে আরাকানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হন। তাঁর তিন রাণী, দুই পুত্র ( মধ্যম ও কনিষ্ট) এবং দুই কন্যাও আরাকানীদের হাতে বন্দী হন। একমাত্র তাঁর জ্যেষ্ট পুত্র চোচং তার অনুগত সৈন্যদেরকে নিয়ে মিছাগিরি থেকে পূর্বদিকে সূদুর বার্মা রাজ্যে পালিয়ে যান এবং সেখানে বর্মী রাজার আশ্রয় লাভ করে।

 

এদিকে সস্ত্রীক রাজা য়েংচোকে বন্দী অবস্থায় আরাকান রাজ্যে নেওয়া হলে আরাকান রাজা মাংথি তাঁকে হত্যা না করে ক্যখক্যা রাজ্যের শাসনভার প্রদান করেন। তিনি রাজা য়েংচো জ্যেষ্ট কন্যা চে মেখ্যাইনকে বিয়ে করেন এবং মধ্যম রাজপুত্র চোপ্রুকে মিঙ রাজ্যের শাসনভার প্রদান করেন। কনিষ্ট রাজকন্যার সাথে আরাকান মন্ত্রী কোরেংগ্রীর পুত্রের বিইয়ে হয় এবং কনিষ্ট রাজপুত্র চতুংকে কাঙ রাজ্যের শাসনভার দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে রাজপুত্র চোপ্রু কিছু প্রজা নিয়ে জ্যেষ্ট ভ্রাতার মত পূর্বদিকে বর্মারাজ্যে চলে যান।

 

এদিকে রাজা য়েংচো পরাজয়ের ফলে সাকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। তাদেরকে পূর্বদিকে স্থাঙ্গুলি থেকে উঠিয়ে এঙ নদী, রো নদী প্রভৃতি নদীর তীরে বসবাসের জন্য নেওয়া হয়।ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তখন তাদের জনসংখ্যা সোয়া লক্ষের মত ছিল। এভাবে সুবিখ্যাত সাক রাজ্য ১৩৩৪খ্রীষ্টাব্দের দিকে ভেঙে যায়। কথিত আছে যে, পরবর্তীকালে কনিষ্ট রাজপুত্র কিছু সংখ্যাক প্রজা নিয়ে আনুমানিক ১৩৬৪খ্রীষ্টাব্দের দিকে আরাকানের উত্তর-পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে আসেন। তাকে অথবা  তাঁর জনৈক সেনাপতিকে অনুসরন করতে করতে “চাক” রা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে লামা মহকুমার য়ংছা এবং গেংগোয়া পর্যন্ত পৌছেছিল। আবার অনেকে রাজপুত্রের সন্ধান না পেয়ে আরাকানে ফিরে যান। এ হলো চাকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

 

বিদ্রঃ চাকদের এই ইতিহাসটি আনুমানিক ১৯৮১-১৯৮৪ খ্রীঃ গিরিনির্ঝর বইয়ে প্রকাশিত হয় (বইটি অনেক পুরনো বিধায় সঠিক সাল পাওয়া যায়নি)।লেখক- মং মং চাক্‌ ।

Share This Post

3 Responses to "চাক্‌দের ইতিহাস ও ইতিকথা, লেখক- মং মং চাক্‌ (গিরিনির্ঝর)"

  1. প্রশংসাযোগ্য প্রচেষ্টা। রেফারেন্সগুলো দিলে আরো ভালো হয়- তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং গবেষনার জন্য।

Post Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.