এক মায়ের গল্প
বেশ কয়েক দিন ধরে শত্রুপক্ষ কঠিন বেড়াজালে এলাকাটাকে ঘিরে রেখেছে। রাতের আঁধারে আগুন জ্বলে উঠে, ঘাঢ় আঁধারে তার লেলিহান শিখা হায়েনার চোখের মতন হুমকি দেয়, কুৎসিত, ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় জ্বলতে থাকে সে লেলিহ শিখা! সবাই বুঝে, কাওকে বলে দিতে হয় না, একটি পরিবারের হাজার বছরের কোটি কোটি স্বপ্নেরা লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে যাচ্ছে। সেই শাংকাতুর আলোর ঝলকানিতে গুমরে উঠে অবরুদ্ব্ব এলাকার সবার মন ও চিত্ত।
গ্রামের পরেই বিস্তৃত ধানক্ষেত, মেঠোজমি। তাই গ্রামের প্রান্ত থেকে চোখে পড়ে শ্ত্রুদের কঠিন বেড়াজাল, আগুনের চারপাশে কালো কালো ছায়ামূর্তির নড়াচড়া, অস্ত্রের ঝনঝনানি, মাঝেসাঝে ফাঁকা গুলির আওয়াজ, জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত লোকজনের উলল উল্লাস ধ্বনি। কিন্তু শত্রুর হাসি আর গানের চাইতে উৎকট, শ্রুতিকটু আর কি হতে পারে?
শহরের মাঝদিয়ে বয়ে চলা খাগড়াছড়ি নদীতে শত্রুরা মৃতদেহ ফেলেছে, হাটবাজারের দিনে দাঙ্গায় আটকে পড়া হতভাগা জুম্মদের লাশ! কে জানে কার বোন, কার অতি আদরের কন্যা বিধবা হল! শহরের চারপাছে আখের ক্ষেত আর ভয়ে ছেড়ে আসা পাহাড়িদের বাসাগুলো লুঠ করার পর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে! পদদলিত করেছে ফসলের ক্ষেত, ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে ফলের বাগান। মূল শহর এখন শত্রুদের অভেদ্য দুর্গ! প্রায় প্রতিদিনই শত্রুপক্ষরা জড়ো হয় শহরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলোতে আক্রমন করার জন্য। বড়ই অরক্ষিত গ্রামগুলো!
গ্রামের ভিতর সদ্য কৈশোর ফেরোনো ছেলেরা ধুলোমাখা পথে টহল দিয়ে ফেরে। ঘরবাড়ির জানালা দিয়ে ভেসে আসে আহতদের চিৎকার, আর্তনাদ, প্রলাপ, নারীদের প্রাথনা আর অবুঝ শিশুদের একঘেয়ে ক্রন্দন। লোকে ফিসফিস করে কথা বলে, বলতে বলতে মাজপথে থেমে যায়, উৎকর্ণ হয়ে কান পাতে,- “শত্রুরা হামলা করল নাকি! এসে পড়লো নাকি!”
সবচেয়ে জঘন্য হয় রাতগুলো। নৈশ-নিস্তদ্বতায় গোঙানি আরও বেশি করে বাজে। শত্রুর রক্তচক্ষুকে আড়াল করে টহল দেয় নৈশ প্রহরিরা। পাহাড়ের কালো চুড়ার উপর তলোয়ারের ঘা-খাওয়া আধখানা ঢালের মতন চাঁদ উঠে। সেই অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় নিজেদের কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, খাগড়াছড়ির চারপাশে ছরিয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাহাড়িরা। বুকে কেবল দীর্ঘশ্বাস আর অফুরন্ত অনিশ্চয়তা। দিন দিন মুক্তির আশা কমে আস্তে থাকে তাদের। একরাশ হতাশা আর আতঙ্ক নিয়ে থাকিয়ে থাকে ভাঙ্গা চাঁদের দিকে। তাকায় করাতের মতন দাঁত বের করা পাহাড়ের দিকে, খাদের আতল গহবর আর কোলাহর মুখর শত্রু এলাকার পানে। কিন্তু সবকিছু থেকে ভেসে আসে মৃত্যুর ফিসফিসানি, আগগণ আকাশে একটাও সান্ত্বনার তারা দেখা যায় না। ভয়ে সন্দ্ব্যার পর কেও ঘরের বাতি জ্বালত না। রাস্তাগুলো ঘাঢ় অন্দ্বকারে মোড়া। আর সেই অন্দ্বকারে আপাদমস্তক কাপড় মুড়ি দিয়ে একজন নারী গভীর জলের মাছের মতন নিঃশব্দে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।
ওকে দেখলে সব গ্রামের লোক কানাকানি করে,- “এ সেই না!”
উত্তর আসত,- “হাঁ, সেই।“
তারপর ওরা সবাই মাথা নিচু করে ওকে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যেত। টহলদার প্রহরীরা রুক্ষস্বরে সতর্ক করে দেয়,- “আবার বেড়িয়েছেন পারুলিকা? সাবধান! কোনদিন মারা পরবেন আর সেদিন আততায়িকে খুঁজে বের করার জন্য কার মাথাবেথা থাকবে না…”
থমকে দাঁড়াত মহিলা, অপেক্ষা করত। প্রহরীরা হইত সাহস পেত না, হইত ভয় পেত কিংবা করুণা বোধ করত অথবা ওর গায়ে হাত দিতে ঘেন্নাবোধ করত। তাই মেয়েটাকে ওরা পাশ কাটিয়ে যেত। আর অন্দ্বকারে মেয়েটা একা একা ঘুরে বেড়াত, এবং গ্রামের সকলের দুঃখ দুর্দশা দেখত। রাত্রির বুক চিরে তার কানে এসে বাজত আর্তনাদ, কান্না, প্রাথনা আর স্বজন হারাদের প্রলাপ।
পারুলিকাকে সবাই পাগল বলত। কিন্তু সে পরিচয় চাপিয়ে অন্য আর একটা পরিচয় আছে তার- সে একজন মা। সে এমন একজনের মা, যার পরিচয় দিতে তার কুণ্ঠাবোধ করত। তবুও তার জমি, জায়গা আর নিজের মেয়ের সম্পর্কে তার ভাবনার শেষ নেই। কেননা আজ যারা এই শহর আক্রমণ চালিয়ে, পাহাড়িদের হটিয়ে জায়গা জমি দখল করছে, তাদেরই একজন ওর মেয়ের জামাই। এমন হাসিখুশি মেয়ে শত্রুপক্ষের ছেলেকে বিয়ে করবে ও ভাবতেই পারেনি। ও কেন, ওর স্বামিও ভাবতে পারেনি। তাইত ওর স্বামি, যখন শুনল ওদের মেয়ে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করেছে, সহ্য করতে পারেননি। ঘটনার আকস্মিকতায় তৎক্ষণাৎ মারা জান তিনি। ও মরে গিয়ে বাঁচলেন আর পারুলিকা বেচে থেকে মরলেন। মেয়েটা ছিল খুব সুশ্রী আর ধার্মিক, একাগ্রচিত্ত ও উদার। অল্প কিছুদিন আগেও নিজের মেয়েকে দেখে গর্বে বুক ভরে যেত পারুলিকার। ভাবতেন, দেশকে বুজি এক দেবী উপহার দিয়েছেন তিনি। যে শহরে ও নিজে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে, সে শহরের কাছে ওর মনে হত তার মেয়ে বুজি এক স্বর্গের দূত, শান্তির প্রতিমূর্তি।
আগগণ অদৃশ্য বন্দ্বনে ওর হৃদয় এই প্রাচীন পাহাড় গুলোর সাথে বাঁধা- এই পাহাড় গুলো ঘিরে ওর পূর্বপুরুষেরা ঘুমিয়ে আছে। এই পাহাড়ের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওর আত্বিয় স্বজনদের অস্তি, তার সাথে সম্পর্কিত মানুষদের আশা আকাঙ্খার গান আর লোকগাথা। আজকাল ওর হৃদয় প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় অশ্রু ভারাক্রান্ত। মনে মনে ও মনের তুলাদ্বন্দ্বে যাচাই করে দেখে, কোনটার ওজন বেশী, মেয়ের জন্য না দেশের জন্য ভালবাসা! কিন্তু কোনটা ওজনদার বুঝতে পারে না পারুলিকা।
এই এমনি ভাবে ও রাতের পর রাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। যারা ওকে চিনতে পারত না তারা করুণা ভরা চোখে থাকাত, আর যারা চিনত তারা নীরবে সরে দাঁড়াত। কোন কথা বলত না।
রাজনীতির ঘৃণ্য খড়গ নেমে আসে খাগড়াছড়ির উপর। রাজধানি থেকে অনেক হোমরা চোমড়া লোকের আমদানি ঘটে। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওরা আবার লুকিয়ে পড়ে গর্তে। সাধারণ পাহাড়ি মানুষ সকল অন্যায় নীরবে হজম করে আবার স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে শুরু করে। শহরে আসা যাওয়া শুরু করে, স্যাতলার আর আর্মিরাও কিছু করে না আর শুধু পরবর্তী হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
কিন্তু পারুলিকার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। সে আগের মতন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
কিন্তু একদিন হাসপাতালের নিভৃত এককোণে ও দেখল এক নারী একটি মৃতদেহের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আছে, এতোই নিস্তদ্ধ যে- ওকে মাটির টিবির মতন মনে হচ্ছে। নক্ষত্রের দিকে বেদনা বিধুর মুখখানা তুলে প্রার্থনা করছে।
পারুলিকা ওকে শুধাল, “একি তোমার স্বামী?”
“না।“
“ভাই?”
“না, আমার মেয়ে। স্বামী মারা গেছেন গত বছর স্যাতলার বাঙালীদের হাতে। তার ছয় মাস পরে ছেলে। আর্মিদের গুলিতে। ছেলে আমার শান্তিবাহিনির সদস্য ছিল। আর আজ মেয়ে।“ শোকাতুর মা উঠে দাড়িয়ে নম্রস্বরে বললেন,- “ভগবান সবই দেখছেন, সবই জানেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।“
“কেন?”
বেধনাহত নারী বললেন, “আমার মেয়ে আত্বহত্যা করেছে। কিছু হতচ্ছাড়া অসভ্য বাঙালি ছেলে ওকে রেপ করতে ছেয়েছিল, ও তা হতে দেয়নি। নিজেকে নিজে শেষ করে দিয়েছে। ওকে নিয়ে আমার ভাবনার অন্ত ছিল না, কেননা ও ছিল বড় দুর্বিনীত, দুরন্ত। আমোদ-ফুর্তি করতে ভালবাসত। ভয় হত, এই বুঝি শত্রুপক্ষের ছেলেকে বিয়ে করলো, যেমন করেছে পারুলিকার মেয়ে। সে হল আমাদের সমাজের শত্রু, জাতির কলঙ্ক। অভিশাপ লাগুক তার আর যে তাকে পেটে ধরেছে সেই মার।“
মুখ দেখে পারুমিতা ওখান থেকে চলে আসলো। পরের দিন দুপুরে এলাকার শান্তিবাহিনির অফিসে গিয়ে বলল, “আমার মেয়ে এই সমাজে কলঙ্ক। তোমরা আমাকে মেরে ফেলো।“
ওরা জবাব দিলো, “তুমি মানুষ। তোমার কাছে তোমার দেশ, মাটি ও সমাস অবশ্যই অনেক বড়। তোমার মেয়ে যেমন আমাদের চোখে কলঙ্ক তেমনি তোমার চোখেও।“
পারুলিকা একঘেয়ে সুরে বলল, “আমি ওর মা। আমি ওকে ভালবাসি। ও যা করেছে তার জন্য আমি দায়ী। তোমরা আমাকে হত্যা করো।“
ওরা নিজেদের ভিতর পরামর্শ করে বলল, “মেয়ের পাপের জন্য তোমাকে হত্যা করা সম্মানের হবে না। আমরা জানি এমন জগন্য অপরাধ করার জন্য তুমি তোমার মেয়েকে শহরে লেখাপড়া করার জন্য পাঠাওনি। আমরা তোমার যন্ত্রণা বুজতে পারছি। মনে হয় তোমার মেয়ে তোমার জন্য উদ্বিগ্ন নয়। তুমি বরং তোমার মেয়ের কাছে শহরে চলে যাও। আমাদের মনে হই এটাই তোমার যোগ্য শাস্তি, মৃত্যুর চাইতে আরও ভয়াভহ।“
“হাঁ, সত্যি,” -বিসন্ন সুরে মা বললেন, “মৃত্যুর চাইতে আরও ভয়ঙ্কর!”
সুতরাং মা এলাকা ছাড়ল, পাহাড় ছাড়ল। মেয়ে থাকে ঢাকায়। সে মেয়ের জন্য ঢাকায় পাড়ি জমাল। দূরপাল্লার গাড়ীতে চলার সময় ওর মন ঢুকরে কেঁদে উঠল। রক্তেস্নাত স্বাদেশভুমি ছাড়তে ওর মন সরছে না, কাদছে আবিরত।
সারাদিন ক্লান্তিকর ভ্রমণের শেষে শেষ বিকেলে তিনি উত্তরার এক আলিশান গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকা দারোয়ানকে বলল, “তোমাদের মাদাম আমার মেয়ে।“
দারোয়ান তা অবিশ্বাস করলো না। বরং মেয়ের প্রশংসা করতে লাগলো, “খুবই মায়াবতি, দয়াবতী, গুণী মেয়ে আপনার।“
পারুলিকা বিস্মিত হলেন না। স্বগরবে মাথা উঁচু করে শুনলেন, কেননা ওর মেয়ে এ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
অবশেষে মা দাঁড়ালেন মেয়ের সামনে। যাকে তিনি চিনতেন জন্মের নয় মাস আগে থেকে, যাকে ও হৃদয় থেকে কখন ও বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। রেশম আর মখমলের আচ্ছাদিত হয়ে ওর সামনে ওর মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে, দুর্লভ রত্নে শোভিত। ঠিক যেভাবে তিনি বহুবার স্বপ্নে দেখেছেন, ধনবতী, গর্বিত আর অসম্ভব সুন্দর।
অবিশ্বাসী মেয়ের চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “মা, তুমি এসেছ!” সারা শরীর জুড়ে অপ্রতিরুধ্য কান্না। আনন্দের কান্না। মা মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন।
মেয়ে বলল, “মা তুমি আর ফিরে যেও না। তোমাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। এখন সবকিছুর অবসান ঘটলো। তুমি আর পাহাড়ে যাবে না, আমার সাথে থাকবে।“
“পাহাড়ের প্রতিটা পাথর তোমাকে চিনে, তোমাকে মেয়েবেলা থেকে জানে।“
“পাথর তো বোবা মা, মানুষ তাদের কথা বলায়। পাহাড়ও আমার কথা বলবে, এক বিজয়িনীর গল্প বলে যাবে যুগ যুগ ধরে।‘
“আর মানুষেরা কি বলবে?” মা জিজ্ঞেস করে।
‘নিঃশ্চয়ই, তাদের কথা আমি ভুলিনি। সব মূর্খের দল, একরোখা। ওদের প্রতি আমার করুণা ছাড়া আর কিছু নেই। ওরাও একদিন আমার পথ ধরবে।“
“সেই তো জয়ী মা, যে নিজের লোকদের সম্মান অর্জন করতে পারে!”
“না,” তিব্র প্রতিবাদ করে মেয়ে। “ওই অর্ধশিক্ষিত, একরোখা, মদখোরদের সম্মান আমি চাই না।‘
এইভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে দুজনের কথা কাটাকটি। মেয়ের অপ্রতিরোধ্য যুক্তির কাছে মা ম্রিয়মান হয়ে যান। তাহার যুক্তি, বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়। তিনি ক্রমশ নত হয়ে যান। মার কাজ মেয়েকে ভুল পথ থেকে ফেরানো। কিন্তু নিজের মেয়েকে নিজের কাছে কেমন জানি অচেনা লাগে পারুলিকার।
মা মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলেন শহরটাকে। সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় রঙিন হয়ে উঠেছে শহরটা, শহরের যত প্রাচীর আর মিনারগুলো, জানালার শার্সিগুলো জ্বলসে ক্রুদ্ব দীপ্তিতে, যেন প্রতিটা ক্ষতমুখ থেকে ঝরে পড়ছে রক্তিম জিবনরস। দেখতে দেখতে পুরো শহর কালো হয়ে গেল আর সমাধি দ্বীপের মতন আকাশে জ্বলে উঠলো কয়েকটা তারা। দূরে কোন মসজিদ থেকে ভেসে এলো আযানের ধ্বনি। সাথে সাথে অনেকগুলো, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে আগে শেষ করতে পারে।
রাতে, ঘাঢ় আঁধারে যখন দেখে গেলো চরাচল, মা মেয়েকে ডেকে বললেন, “ আয় সোনা, আমার বুকে মাথা রেখে একটু শো। মনে পড়ে তুই ছোটবেলায় কত উছচ্বল আর সুন্দর ছিলি, সবাই তোকে কেমন ভালবাসত…”
“আমি ভালোবাসি শুধু নিরাপদ আর সুখী একটা জীবন।“ মার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজিয়ে মেয়ে বলল, “আর ভালোবাসি শুধু তোমাকে। কেননা আমি যা হয়েছি, যা পেয়েছি তা শুধু তোমার জন্য।“
মা গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। “তুই সুন্দর দেখতে হলেও বিদ্যুৎ চমকেরই মতো ব্যর্থ।“
‘হাঁ, আমি বিদ্যুৎ চমকেরই মতো। …”
মেয়ে মৃদু স্বরে জবাব দিল, তারপর মার কোলে ছোট্ট কন্যার মতন ঘুমিয়ে পড়লো।
নিজের খাদির আচল দিয়ে মেয়েকে ঢাকলেন মা, তারপর সুদূর পাহাড় থেকে নিয়ে আসা পাহাড়ি ছুরিটার ফলাটা মেয়ের বুকে বসিয়ে দিলেন। দু-একবার থরথর করে মেয়ে মারা গেল। মেয়ের বুকে কোথায় ধুকপুক করেছিল মার চাইতে বেশী আর কেও জানেনা। মা ফিসফিস করে বললেন, “মানুষ হিসেবে জাতির জন্য যা করার কথা আমি তা করেছি, কিন্তু মা হিসেবে আমার সত্ত্বা মেয়ের সাথে জড়িত। সন্তানের রক্তে রঞ্জিত করেছি এই হাত, তখন আর আমার বাঁচার কোন অধিকার নেই।“
মেয়ের রক্তে তখনও উষ্ণ ছোরাখানা মা দৃঢ়হাতে বসিয়ে দিলেন নিজের বুকে। একবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না, কেননা ব্যথিত হৃদয়টাও খুব সহজে খুঁজে পেয়েছিল।
(বিদেশি কাহিনী ছায়া অবলম্বনে রচিত)