নন্দলাল শর্মা
চাকমা লোককথায় লোকজীবন
আদিকাল থেকেই লোক সমাজে লোককথা প্রচলিত হয়েছে। “লোককথার প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, শ্র“তি পরস্পরায় যে সকল বিষয়বস্তু চলিয়া আসিতেছে, তাহাই ইহার উপকরণ কোন মৌলিক বিষয়বস্তু ইহার উপজীব্য হইতে পারে না। আধুনিক কথা সাহিত্যের সঙ্গে এখানেই ইহার মৌলিক পার্থক্য ….. লোককথা অতিরিক্ত রোমান্স ধর্মী, কল্পনার স্বপ্নরাজ্যে ইহারা স্বাধীন বিহার করিয়া থাকে। …. কতকগুলি লোককথার ভিতর দিয়া জীবনের ছোটখাট অসম্মতি ও দোষত্র“টি কৌতুকের স্পর্শ লাভ করিয়া উজ্জ্বল হইয়া কন্ঠে” (আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা লোকসাহিত্য, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০১)।
লোককথা পাত্র-পাত্রী মানুষোত্তর প্রাণী পশু-পাখি হতে পারে। মানুষ, পরী, দৈত্য, পশু-পাখি সবই লোককথার চরিত্র হতে পারে। একই লোককথা বিভিন্ন দেশেও প্রচলিত আছে। লোককথা লোকমুখে রচিত ও প্রচারিত হয়ে থাকে। আধুনিককালে তা বানীবদ্ধ করা হচ্ছে। বানীবদ্ধ করা কালে অনেক ক্ষেত্রে মূল ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আঞ্চলিক ভাষায় কথক লোককথা বর্ণনা করেন।
চাকমা জাতির লোকসাহিত্যের একটি প্রধান শাখা লোককথা। এই লোককথাগুলো শ্র“তি পরস্পরায় সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে। কে এই লোককথার রচয়িতা তা জানা যায় না। লোককথাগুলো লোক সমাজের মনোরঞ্জন করে আসছে। লোককথায় অপ্রচলিত ও আপাত দৃষ্টিতে অবাস্তব উপকরণ উদাহরণ প্রচলিত থাকে। এজন্য রসগ্রহণে অসুবিধে হয় না। প্রাচীন লোক সমাজের কেউ এর প্রবর্তক। এ সকল কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে শ্র“তির মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে এসকল কথার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সর্বজনীন আবেদন রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
চাকমা লোককথায় লোকজীবনের নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। এ সম্পর্কে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বর্তমান নিবন্ধের ল্য। কয়েকটি লোককথায় লোক জীবনের উপাদান সম্পর্কে আলোকপাত করা যাচ্ছে।
‘জামাই সারণী’ কাহিনীকে সতীশ চন্দ্র ঘোষ ঐতিহাসিক কাহিনী বলে অভিহিত করলেও আসলে এটি উপকথা। সেকালে রাজকন্যার স্বয়ংবর পদ্ধতিতে বিয়ে হত। পানি প্রার্থী রাজ কুমারগণ পরী দিতেন। পরীয় উত্তীর্ণ রাজপুত্রের গলায় রাজকন্যা মালা পরাতেন। রামায়ণে সীতা এবং মহাভারতে দ্রোপদীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ আছে। দু’ হাজার বছরেরও আগের স্বয়ংবর পদ্ধতি জামাইমারণী’ কাহিনীতে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে এসেছে।
‘গোমতী নদীর কথা’য় জুম চাষের প্রসঙ্গ আছে। এই পুরাকথার সঙ্গে চাকমা জাতির সাংস্কৃতিক বিশ্বাস জড়িত। পাহাড়-পর্বত, নদনদী, পশুপাখি প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে অনেক আদিবাসীর মধ্যেই পুরাকথা প্রচলিত আছে। এই কাহিনীতে সংস্কার ও অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসের কথা আছে।
‘ছুরন্যা ছুরনী’ কাহিনীতে ছুরন্যা পিঠে খেতে চেয়েছে। দা কুড়–ল নিয়ে সে জঙ্গলে গিয়ে গাছ কেটে এনে ঢেঁকি বসিয়েছে। বাঁশ কেটে এনে তার বেত তুলে কুলো ও চালনি বুনেছে। চাল ভিজিয়ে ঢেঁকিতে কুটে খুব মিহি গুঁড়ো তৈরি করে পিঠে কলা পাতায় মুড়ে পোগোনে সাজিয়ে উনুনে চড়িয়েছে। ছুরনা ও ছুরনী দা কুড়–ল নিয়ে পিঠে কাল্লোং বেঁধে কাঠ সংগ্রহ করতে জঙ্গলে গিয়েছে। পিঠে তৈরীর প্রসঙ্গ বিভিন্ন লোককথায় আছে।
‘টুনটুনি আর কুনোব্যাঙ” লোককথায় লোকবিশ্বাস ও লোক সংস্কারের পরিচয় মেলে। ‘বুড়ো-বুড়ি আর বাঁদরের দল’ লোককথায় কচু চাষ, লাউয়ের খোলার মধ্যে নুন রাখা এবং জুম চাষের প্রসঙ্গ আছে। এই কাহিনীতে বাঁশের ফালি দিয়ে মাছ ধরার গোল চাই তৈরি করার কথা আছে।
‘রোভ্যাবেঙার ধুন্দাখানা’ (বা তামাক খাওয়া) লোককথায় জুম চাষের কথা, মোনঘরে বিশ্রাম নেয়ার কথা আছে। সকালে উঠে কারো মুখ দেখলে ভালো হয়, কারো মুখ দেখলে মন্দ হয়-এ সংস্কারটির উল্লেখও এতে আছে।
‘শেয়ালের নাকানি’ লোককথায় দেখা যায় মুরগি, কচ্ছপ, শুয়োর শেয়াল ও বাঘ একসঙ্গে কাট্টনে গেছে। ব্যবসার জন্য দূরবনে গিয়ে বাঁশ গাছ ইত্যাদি কেটে নিয়ে আসাকে চাকমা সমাজে কাট্টন বলে।
‘বনবিলাস’ প্রথম পর্বে জুমে ধান পাকলে পাখি তাড়ানোর ও চরকা দিয়ে সুতো কাটার প্রসঙ্গ আছে। জুমে যাবার সময় কচি কলাপাতায় মুড়ে ভাত ও তরকারির পুঁটলি তৈরী করে বড় খেতের ধামায় পুরার কথাও এতে আছে। একাহিনীতে জামাইকে শনঘরে শোবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এই লোককথায় মেয়েদের খাড়–, পিনোন, খাদি ও রূপোর হাঁসুলি ব্যবহারের প্রসঙ্গ আছে।
‘ধবি আর কবি’ লোককথায় জুমে ধান, তিল, কার্পাস কুমড়ো, মারফা চিনার চাষের কথা ও
েেত নিড়ানি দেয়ার কথা আছে। অন্য গ্রাম থেকে কত্তিতে ভড়ে পানীয় জল সংগ্রহের প্রসঙ্গও আছে।
‘অমগদ চাকমা’ লোককথায় মশাল জ্বেলে ভূত তাড়ানো ছাড়াও একটি লোক সংস্কারের প্রসঙ্গ আছে। এটি হল ভূতেরা মেইয়া শাক ভয় করে। মেইয়া শাক যারা খায়, ভূত তাদের কোনো তি করতে পারে না বলে চাকমাদের বিশ্বাস। ভূত যাতে বাড়ির ধারে কাছে আসতে না পারে সেজন্য আগেকার দিনে বাড়ির পাশে মেইয়্যা শাক বুনে দেয়া হত। লোক বিশ্বাস ভূতকে কোনো কৌশলে বধ করা হলে পরদিন সকালে ভূতের লাশের পরিবর্তে দাড়কাক বা কুকুরের লাশ দেখা যায়। অমগদ চাকমা তাগলের একটি কোপে ভূতের শিরশ্চেদ করেছিল। পরদিন লোকজন ভূতের লাশ দেখার জন্য ভিড় করে। কোথায় ভূত? তারা দেখতে পায় মরা দাঁড়কাক- যার গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন।
‘দুলু কাহিনী’ লোককথায় উঠানে তলুইয়ে ধান শুকানোর প্রসঙ্গ আছে। আছে বেতের তৈরী ঝুড়ি বারেং ব্যবহারের কথাও।
‘বার্গী পজ্ঝ্ন’ লোককথায় জুম চাষ থেকে ভাইবোনে তরিতরকারি সংগ্রহের কথা আছে। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে শুয়োরের জন্য খোঁয়ার তৈরী করা, মাটিতে ঘুঙুরার বাসা তৈরী করা, পশ্চিমদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বার্গী আসা এবং বিন্নি চালের অপরশ্রি“ত সুরা জগরাহ্ এর প্রসঙ্গ এতে আছে।
‘মূলঝি কন্যা’ লোককথায় কাত্তোনে যাবার কথা আছে। চরকায় সুতা কাটা, পিঠা তৈরী করা প্রভৃতি প্রসঙ্গও আছে।
‘রাঙ্গামাটির রাজকন্যা রাঙাবি’ লোককথায় বিঝু উৎসব পালন, ফুলবিঝু দিনে নদীতীরে গিয়ে কলাপাতায় নানা রঙের ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, বাঁশের তৈরি সাঁকো, ভাতঝরা ফুল, কলাপাতায় মোড়ানো সুগন্ধযুক্ত খাবার, ঘিলাখেলা, হরিণ শিকার, বাঁশের ফালি দিয়ে তৈরী বাদ্যযন্ত্র, খেংগরং, বেইন দিয়ে আলাম ও ফুলখাদি বোন প্রভৃতি প্রসঙ্গ আছে।
‘গুঅচেল্যা বলী’ লোককথায় ছড়া থেকে শামুক এনে রান্না করা, নৌকা প্রস্তুত করা, কেরেত টানা, উদোল টানা(এক ধরনের আঁশযুক্ত গাছের আঁশ) ছাড়ানো, ধ (একমুখ খোলা এবং অপর অংশে গ্রন্থিযুক্ত বাঁশের পাত্র বিশেষ) তৈরী করা, ছড়ায় বাঁধ দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া ধরা প্রভৃতি লোক উপাদানের বর্ণনা আছে।
চাকমা লোককথা চাকমা লোকজীবন থেকেই উদ্ভুত। তাই সেই জীবনের পরিচয় এতে ফুটে উঠেছে। নগর সভ্যতা বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা কারণে লোক সমাজে পরিবর্তন এসেছে। এজন্য লোককথাগুলি সংগৃহীত, সংকলিত ও গ্রন্থিত হোক এবং এগুলো নিয়ে গবেষনা করা হোক- এই প্রত্যাশা আমাদের।
এই লেখাটির মূল লিংকঃ- বনযোগীছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতি http://banajogichara.org/?p=78