রাধামন ধনপুদি কাহিনী –(চাকমাদের এক প্রেমের কাহিনী) -১
সুগত চাকমা
টাইপিংয়ে – অমিত হীল
অতীতে চাকমাদের আদি নিবাস ছিল চম্বকনগর । সেই চম্বকনগর রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পাহাড়ী গ্রামের নাম ছিল ধনপাদা । গ্রামটি ছিল ধনে জনে পরিপূর্ণ এবং ঐ গ্রামের ছ্য় কুড়ি মানে একশ বিশটি পাহাড়ী পরিবার বাস ক রতো । ঐ সময় সব চাকমারা মাচাং ঘরের উপরবাস করতো । ধনপাদা গ্রামের সব বাড়ীই ছিল মাচাংঘর বিশিষ্ট । চাকমারা যে সকল গ্রামে গ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে বেহালা বা বাঁশি বাজিয়ে নানা ধরনের পালাগান গায় তাদেরকে ‘গেংগুলি’ বা ‘গেংখুলি’ বলে ।
গেংগুলিদের গানে ছয় কুড়ি গৃহস্থের গ্রামকে সমৃদ্ধশালী গ্রাম অর্থে ‘ভরন্ধি আদাম’ বলা হয় ঐ ধনপাদা গ্রামে মেনকা এবং কপুদি নামে দুই বোন বাস করতো । দু’বোনেরই অবস্থাপন্ন পরিবারে বিয়ে হয়েছিল । মেনকার স্বামীর নাম ছিল জয়মঙ্গল এবং কপুদির স্বামীর নাম ছিল নিলগিরি । জয়মঙ্গল কেবল অবস্থাপন্ন ব্যক্তিই ছিল না, গ্রামে তাদের পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি ও ছিল । মেনকার ছেলে রাধামন এবং কপুদির মেয়ে ধনপুদি । বয়োজোষ্ঠতার দিক থেকে রাধামন ধনপুদির চেয়ে এক বছরের বড় ছিল, তারা যখন ছোট ছিল তখন অনেক সময় তাদের নানা-নানীরা তাদেরকে একত্রে একই দোলনায় রেখে দোলাতো এবং ঘুম পাড়ানি গান ‘অলিদাগনি’ – গীত গেয়ে ঘুম পাড়াতো ।
এভাবে দোলনায় দুলতে দুলতে শিশু দু’টি বেড়ে ওঠতে লাগলো । তারপর তারা একদিন দোলনা ছেড়ে মাটিতে নেমে খেলা করতে লাগলো । নানা ধরনের খেলা – ঘিলা খেলা, নাধেং খেলা আরো কত কি ! কখনও বা তারা মুখে একফালি বাঁশের টুকরা নিয়ে ‘খেংগরং’ কিংবা এক টুকরো বাঁশ থেকে তৈরি ‘ধুদক’ বাজাতে শিখলো । এভাবে তারা হেসে খেলে বড় হতে লাগলো । বয়স একটু বাড়তেই সঙ্গীসাথী ও জুটলো অনেক । তবে তারা সাত জোড় সঙ্গীসাঠীই অধিক ঘনিষ্ট হয়ে বন্ধুত্ব জুড়লো । এ সাতটি জোড় হলো –রাধামন ধনপুদি, নিলংধন-নিলংবি, কঞ্জধন-কুঞ্জবি, কামেচধন-কামেচবি, ফুজুকধ -ফুজুকবি, মেইয়াধন-মেয়াবি এবং ছেইয়াধন-ছেইয়াবি । এ সাত জোড় সঙ্গীসাথী সবাই গ্রামের মুরুব্বী চলাবাপকে (Aju Cholabap) ‘আজু’ ডাকতো । চাকমা ভাষায় ‘আজু’ শব্দের অর্থ হলো দাদু বা নানা । চলাবাপ কৌতুকপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন । তিনি নাতি-নাতনী বয়সী গ্রামের সব ছেলেমেয়েদের সাথে ঠাট্রা তামাশা করতেন । আবার কখন ও কখন ও তাদের সবাইকে নিয়ে দূরের পাহাড়, নদী ও অরণ্যে নানা ধরনের এডভেঞ্চারমূলক ও আনন্দদায়ক ভ্রমনে বেড়িয়ে পড়তেন । জুম-বেরাঃ -জুম করার জন্য কৈশরদের কাছে চলাবাপের প্রস্তাব এমনি একদিন চলাবাপ তার নাতি-নাতনীদের সাথে একটি জোছনা রাতে বসলেন । এ কথা সে কথা নানা কথার পর চলাবাপ উঠতি কিশোরদের দূর পাহাড়ে গিয়ে ঝোপঝাড় কেটে জুম চাষ করার প্রস্তাব দিলেন । পাহাড়ের ঢালু অংশে ঝোপঝাড় কেটে, এরপর সেগুলি রোদে শুকিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে যে চাষ করা হয় তাকে জুম-চাষ এবং যেখানে জুমচাষ করা হয় তাকে ‘জুম’ বলে । আর জুম চাষ করার সময় ঝোপঝাড় কাটাকে ‘জুম-কাবা’ বলে । সেদিন চলাবাপের ‘জুম-কাবা’র প্রস্তাবকে উঠতি কিশোররা সানন্দে উৎফুল্ল চিত্তে গ্রহণ করলো । তাদের সে উৎসাহ কিশোরীরাও সায় দিল । তারাও তাদের সাথে জুমে স্থান নির্বাচিত করার ব্যাপারে দূড় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাজী হলো । সেদিন রাতে চলাবাপ এবং সাত জোড় সঙ্গীসাথী এরপর ‘জুম-বেরা’ দিন ঠিক করলো মানে জুমের জন্য পাহাড়ে যাওয়ার দিন ধার্য করলো ।
তারপর একদিন সোমবারে তারা তাদের গ্রাম ধনপাদা থেকে পশ্চিম দিকে রওনা হলো । কিশোরেরা চলাবাপের নেতৃত্বে হাসি-আনন্দে ফুগংতলী দ্যমুরা পর্বতে পৌঁছলো । তারা পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠে পাহাড়ের পার্শ্বদেশ গুলিতে বেড়াতে শুরু করলো; উদ্দেশ্য যার যার জুমের জন্য স্থান নির্বাচন করা। জুমের স্থান নির্বাচনের কাজ শেষ হলে তারা ইষ্টদেবতা স্মরণ করে ‘তাগল’ নামক এক প্রকার দা দিয়ে যার যার জুমের ঝোপঝাড় কাটা শুরু করলো । এভাবে তারা সারাদিন জুম-এর জন্য ঝোপঝাড় কেটে বিকালে যার যা বাড়িতে ফিরলো । সেদিন সারাদিন জুমের জন্য কাজ করার পর রাধামন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল । তাই সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল । আর ঘুমিয়ে পড়তে বা পড়তেই স্বপ্ন দেখতে লাগলো ।
সে স্বপ্নে এক বুড়িকে দেখলো । ঐ বুড়ি দু’হাতে ‘রেগোচ’ ফুল নিয়ে পাহাড়ে এবং পার্শ্বদেশস্থ জুমে ঘুরে বেড়ালো । ঘুম ভাঙার পর সে তার স্বপ্নের মানে জানার জন্য নানা চলাবাপের কাছে গেলো । চলাবাপ স্বপ্নের কথা শুনে সে বছর জুম চাষ খুব ভালো হবে বললো ।
(চলবে……….)
বিদ্রঃ এই পোষ্টটি অমিত হিল এর লেখা। ফেসবুক আমিত হিলের নোট থেকে নেয়া এবং পোষ্টটি প্রকাশ করার জন্য লেখকের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। ছবি- সত্রং চাক্মা ( সমকাল পত্রিকা )